বুধবার, ২০ নভেম্বর ২০২৪, ০৭:৩২ অপরাহ্ন
সারা বিশ্বের দুই তৃতীয়াংশের বেশী মানুষের স্বপ্নের নগরী “লন্ডন” এখন মৃত্যু নগরীতে পরিনত হয়েছে। এখানে আর আগের মত আনন্দ উচ্ছাস নেই, নেই কোন আমেজ, নেই কোন কোলাহল, দিনের মত জেগে থাকা রাত গুলো যেন ভুতের নগরীতে পরিনত হয়েছে।
বিশ্বের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে মানুষের আনা গুনা নেই, ব্যবসা-বানিজ্য, লেনদেন-আদান-প্রদান, সবকিছু স্থবির। আত্নীয়-স্বজন , বন্ধু-বান্ধব সবাই নিস্তেজ, পাড়া-মহল্লা, হাট-বাজার সবই নিরব। ভার্চুয়াল সম্পর্ক ছাড়া সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ। মায়ের ঘরে সন্তান, ভাইয়ের ঘরে বোন , ছেলে মেয়েদের ঘরে আপন পিতা-মাতা, দাদা-দাদীর ঘরে দৌহিত্র-দৌহিত্রী না যেতে পারার যন্ত্রণা কত যে কষ্টদায়ক তা শুধু ভোক্ত ভোগীরা বলতে পারবেন। কারো বিপদে পাশে না দাঁড়াতে পারা, ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও কাউকে সাহায্য করতে না পারা, কাংখিত মানুষদের দেখতে না পারা, তুমি তোমার আমি আমার এই সুত্র যেন কিয়ামতের কথাই জানান দিচ্ছে।
মানুষ মরণশীল, সবাইকে মরতে হবে, এই চীরন্তন বাণী সবাই মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন। কিন্তু লন্ডনের বর্তমান পরিস্থিতিতে কারো মৃত্যু বড়ই নিষ্টুর। অদৃশ্য শক্তির কাছে পরাজিত হয়ে হাসপাতালে গেলেই যন্ত্রণার তীব্রতা বহুগুনে বেড়ে যায়। মৃত্যু শয্যায় আপনজন যখন কাছে যেতে পারেন না , কিংবা মৃত্যু শয্যায় ধাবিত ব্যক্তি যখন আপনজনকে কাছে পান না, তখন উভয়ের মানষিক ও শারিরিক অবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ে। শেষ বারের মত একটি বার আপনজনকে দেখতে না পারার বেদনা কত যে কষ্টের তা হয়ত মৃত ব্যক্তিকে পুনরায় জীবিত করতে পারলে অনুমান করা যেত। মৃত্যুর পরও কিন্তু কষ্টের সমাধি ঘটে না। একদম নিকট আত্নীয় ছাড়া দাপন-কাপনে যাওয়ার সুযোগ নেই। কবরস্থানে বেশীক্ষণ দাড়িয়ে মৃত ব্যক্তির জন্য প্রার্থনা করা যায় না, পরবর্তি লাশের জন্য তাড়াহুড়া করতে হয়। রাত পোহালেই কবরস্থান, ফিউনারেল সার্ভিস, হাসপাতাল গুলোতে যেন ভিড় আর ভিড়। এম্বুলেন্স, লাশ বহনকারী গাড়ী, লাশ রাখার হিমাগারে লম্বা-লম্বা লাইন। লাইন যত লম্বা হচ্ছে মৃত্যুর মিছিলের সংখ্যা ও তত বাড়ছে! এ যেন এক মৃত্যুপুরী।
মৃত্যুপুরীর মিছিল যেমন তামছে না, তেমনি থামছে না স্বজনদের আহজারী! ক্রন্দন আর আহাজারীতে আকাশ-বাতাস ভারী হলেও মুক্তি পাওয়ার জন্য, প্রার্থনা জানানোর পবিত্র স্থান ধর্মীয় উপসানালয় গুলোও বন্ধ। মন খুলে সম্মিলিতভাবে না কারো জন্য দোয়া করা যাচ্ছে, না কারো জন্য দোয়া চাওয়া যাচ্ছে। হতাশা আর দুশ্চিন্তায় অনেকেই ভুগছেন। নিজের আত্নীয় স্বজন বন্ধু-বান্ধবের অসুস্থের কথা শুনলেই অনেকেই মানসিকভাবে ভেঙে পড়ছেন।
স্থানীয় গণমাধ্যমের সুত্র অনুযায়ী প্রতি ২০ জনের মধ্যে একজন অসুস্থ। এর মধ্যে আবার অনেকেই আত্নসম্মানের কথা ভেবে প্রকাশ করছেন না। নিজের পরিবারের মধেই অদৃশ্য শক্তির সাথে পাঞ্জা লড়ে কেউ বা জিতে যাচ্ছেন আবার কেউ বা হেরে যাচ্ছেন । তাই পুরোপুরি হিসাব বলা ও কঠিন। আমাদের এশিয়ান কমিনিউটি তথা বাংলাদেশী কমিনিউটির অবস্থা যে খুবই খারাপ তা বলার অপেক্ষা থাকে না। সবাই সবার মত করে বেঁচে থাকার তাগিদে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন। আশার কথা ফাইজা আর অক্সফোর্ডের ভ্যক্সিন বাজারজাত এবং অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে প্রয়োগ করা হলেও সর্বস্তরের মানুষের কাছে পৌছানো সম্ভব হচ্ছে না, কবে যে সর্বসাধারণ এর জন্য উম্মুক্ত হবে তার কোন নির্দিষ্ট সময় সীমা নেই।
মহামারী শুরু হওয়া থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত সর্বমোট আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ৩.১৬ মিলিয়ন এবং মৃতের সংখ্যা প্রায় ৮৫ হাজার। প্রতিদিন তার সাথে যুক্ত হচ্ছে গড়ে আক্রান্তের সংখ্যা ৫০-৬০ হাজার আর মৃতের সংখ্যা ১১-১২ শত। রাষ্ট্রের উর্ধ্বতন মহল থেকে শুরু করে, সর্বস্তরের জনগণ ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর, ভাইরাস রোধে চেষ্টা সাধনার কোন কমতি নেই। চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিত কর্মীরা দিন-রাত পরিশ্রম করে ও এই সংখ্যাকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছেন না। এ ভাবে আরো কয়েক মাস চলতে থাকলে, বৃটেনের অবস্থা যে কত করুণ হবে তা বলার অপেক্ষা থাকে না। মৃত্যু নগরী লন্ডনের এই করুন অবস্থা অচিরেই দূর হোক। আপন মহিমায় ঘুরে দাঁড়াক স্বপ্নের বৃটেন। আবারো প্রাণ চাঞ্চল্য হোক স্বপ্নপুরী লন্ডন। এটাই সকল জাতের, সকল গোত্রের, সকল ধর্মের একান্ত প্রার্থনা।
(লন্ডন প্রবাসী আক্তারউজ্জামান নাসির এর ফেসবুক টাইমলাইন থেকে নেওয়া)